বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন: ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের কী হবে

মতামত

পরিবেশবাদীসহ অন্যদের দৃষ্টি এখন ২৭তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের দিকে। নভেম্বরের ৬ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, মিসরের পর্যটন নগরী শার্ম এল-শেখে। প্রথমবার ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিন শহরে এ সম্মেলন হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এটি হয়ে থাকে। এযাবৎ ২৬টি জলবায়ু সম্মেলন হয়েছে। সর্বশেষ ২৬তম জলবায়ু সম্মেলন হয়েছিল ২০২১ সালের নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে।

বৈশ্বিক এই জলবায়ু সম্মেলনগুলো হয়ে থাকে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের রূপরেখা/ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) রূপরেখার আলোকে। তবে এই বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তথ্য–উপাত্তসমৃদ্ধ সর্বশেষ প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের রূপরেখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের আন্তসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত প্রথম আর্থ সামিট ও ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আর্থ সামিটের (জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলন) সিদ্ধান্তের ফলে। তাই বলা যায়, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে।

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের মূল কাজ বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য হুমকি মোকাবিলা করার ব্যাপারে ১৯৭টি দেশ ও অঞ্চলকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা। প্রতিটি জলবায়ু সম্মেলনেই কিছু না কিছু নতুন বিষয় সামনে আসে। এযাবৎ প্রায় দুই ডজন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে। তবে মোটাদাগে বলা যায়, প্রথম দশকে সমঝোতার মূল বিষয় ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাকে থামিয়ে বা কমিয়ে দেওয়া বা প্রশমন (মিটিগেশন)। কিন্তু দ্বিতীয় দশকে এসে আইপিসিসি চতুর্থ মূল্যায়ন রিপোর্ট পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিল যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় শুধু মিটিগেশন যথেষ্ট নয়। এর পর থেকে আলোচনায় মিটিগেশনের পাশাপাশি গুরুত্ব পেল জলবায়ু অভিযোজন (অ্যাডাপটেশন)।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে উন্নত বা সম্পদশালী দেশগুলো এ ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। আবার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেকেই অভিযোজন করতে পারে না সম্পদের অপর্যাপ্ততার কারণে। কখনোবা অভিযোজন করার পরও ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার দেশগুলোর অভিযোজনের জন্য এর আগে অ্যাডাপটেশন ফান্ড, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড ইত্যাদি নামে তহবিল দিতে চেয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত সম্পদশালী দেশগুলোর জোট। ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রুত অর্থের খুব সামান্যই দিয়েছে বিভিন্ন জলবায়ু তহবিলে। ফলে প্রান্তিক জাতি/দেশ সমূহ ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করার জন্য লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড নামক আলাদা তহবিল চেয়ে আসছে উন্নত দেশগুলোর কাছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ থেকে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতিকে লস অ্যান্ড ড্যামেজ বলা হয়। যেমন ঘূর্ণিঝড়, খরা, তাপপ্রবাহ, মরুকরণ, লবণাক্ততা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি। সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও অর্থনীতিবহির্ভূত ক্ষয়ক্ষতি, যেমন পরিবেশ বা প্রতিবেশের ক্ষতি, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি, বাস্তুচ্যুতির কারণে সামাজিক ও মানসিক ক্ষতি—এসবই লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের মধ্যে পড়ে।

বাংলাদেশের জন্য কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিং। ফেব্রুয়ারি ২০২২–এ প্রকাশিত আইপিসিসির ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা ক্রমেই বেড়েছে। ফলে ধীরগতির দুর্যোগ, যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, মরুকরণ ইত্যাদিও বাড়বে। কৃষি, বনায়ন, মৎস্য, পর্যটনসহ বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, সম্পদ ও সরবরাহব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অর্থনৈতিক ও অর্থনীতিবহির্ভূত ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন, জীবিকা ও খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বাস্তুচ্যুতি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতিকে গুরুত্বসহকারে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো থেকে সাড়ে তিন কোটি পর্যন্ত মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটতে পারে।

লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর মতামতের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করলে জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতিকে মোকাবিলা করা সহজ হবে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষকদের জন্য বিরূপ আবহাওয়ার ক্ষতি মোকাবিলায় শস্যবিমা, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, জীবিকা পুনরুদ্ধার, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ সহায়তা ইত্যাদি সবই সম্ভব হবে লস অ্যান্ড ড্যামেজের ফান্ড থেকে। এমনকি এই লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড থেকে স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসন এবং নতুন জীবিকা অনুসন্ধানে সহায়তা করা যাবে।

বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করেই ২০০৭ সালে ১৩ম জলবায়ু সম্মেলনে বালি কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ আনুষ্ঠানিক আলোচনায় আসে। পরে ২০১০ সালে ১৬তম জলবায়ু আলোচনায় লস অ্যান্ড ড্যামেজের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে দোহায় ১৮তম জলবায়ু আলোচনায় ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় লস অ্যান্ড ড্যামেজের অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য আলোচনা হয়। তবে সত্যিকারের উদ্যোগটি ঘটে ২০১৩ সালের জলবায়ু আলোচনায়। সেখানে সব পক্ষ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা কমিয়ে আনা এবং বন্ধ করার জন্য ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম (ডব্লিউআইএম) ফর লস অ্যান্ড ড্যামেজ নামক একটি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে একমত হয়। আর ২০১৫ সালে ১৯তম জলবায়ু আলোচনায় প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল-৮–এ লস অ্যান্ড ড্যামেজের আওতায় ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে পরিকল্পনার একটি কার্যকর ধারণা দিয়েছে। আমরাও অনেক আশাবাদী হয়ে উঠলাম। তবে পরের জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে কার্বন উদ্‌গিরণের জন্য দায়ী ধনী এবং সম্পদশালী দেশগুলো ক্ষয়ক্ষতির ঐতিহাসিক দায় তাদের ঘাড়ে আসতে পারে ভেবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের আলোচনা আর বেশি দূর এগোতে দেয়নি।

তা সত্ত্বেও ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম তার সভাপতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের দাবি জোরালোভাবে উপস্থাপন করে। যদিও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় অর্থায়নের এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত উন্নত দেশগুলো গ্রহণ করেনি, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় দুই বছর সময়সীমার গ্লাসগো আলোচনা (গ্লাসগো ডায়ালগ) চালু করেছে। যার লক্ষ্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা কমিয়ে আনা এবং বন্ধ করার উপায় বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তা নিশ্চিতের জন্য সান্তিয়াগো নেটওয়ার্কে অর্থায়ন করার বিষয়ে আলোচনা। এ ছাড়া আশার কথা হলো ডব্লিউআইএমের কার্যকরী কমিটি পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনায় (২০২৩-২৭) অভিবাসন, বাস্তুচ্যুতি এবং পরিকল্পিত পুনর্বাসনে সহায়তা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের বিষয়ে এযাবৎ দৃশ্যমান বড় কোনো অগ্রগতি না হলেও এ ইস্যু আগামী ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হবে। লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংকে একটি সুনির্দিষ্ট আলোচ্য সূচি হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্কের উদ্যোগে ৪০০–এর বেশি সংগঠন গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের দায়িত্ব হলো মিসরের সম্মেলনে জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতি এবং তা থেকে উদ্ভূত বাস্তুচ্যুতি মোকাবিলার আলোচনায় কয়েকটি বিষয়ে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করা। এর মধ্যে রয়েছে যেমন ভবিষ্যতের সব জলবায়ু আলোচনায় লস অ্যান্ড ড্যামেজকে যেন একটি একক এবং স্থায়ী আলোকসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এটি দেখভাল করার জন্য যেন সুনির্দিষ্ট ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় অর্থায়নকে যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়। জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতিকে অন্তর্ভুক্ত করে জলবায়ু বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকি কমানো এবং অভিবাসনকে নিরাপদ করার জন্য বৈশ্বিক নীতির যেন পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। সান্তিয়াগো নেটওয়ার্ককে যেন সংশ্লিষ্ট স্থানীয় পর্যায়ের সংগঠন এবং বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে তারা ক্ষয়ক্ষতি এবং অভিবাসনের তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করে অভিবাসন বিষয়ে কারিগরি সহায়তা প্রদান করতে পারবে।
বাংলাদেশের জনগণ যাঁরা জলবায়ু–সংকটে ভুগছেন, তাঁরা এই সংকটের জন্য দায়ী নন। আমাদের জোরালোভাবেই প্রশ্ন তোলা উচিত, উন্নত দেশগুলোর বারবার জলবায়ু–ন্যায্যতাকে অস্বীকার করার নৈতিক দিকটিকে নিয়েও। তারপরও আমরা আশাবাদী যে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কার্যকর একটি আলাদা তহবিল সৃষ্টির বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে।