স্মরণে মিতা হক: তাঁকে ভুলে যাওয়া কি সম্ভব

মতামত

মিতা হক, একজন সংগীতশিল্পী, শিক্ষক ও সংগঠক—যাঁর নাম বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীতের শুদ্ধ ধারার চর্চা, প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। শিক্ষক হিসেবে খোলা গলায়, সঠিক, সাবলীল উচ্চারণে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার এক ধারা তিনি শুরু করেছিলেন, যা ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে এখনো বিদ্যমান। তাঁর গানের মাধ্যমে যে রূপে প্রাণ সঞ্চারিত হয়, তা বিরল। সংগীতশিল্পী মিতা হককে অনেকেই চেনেন। সংগীতগুরু হিসেবেও তিনি অসংখ্য মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছেন। এর মধ্যে আরও কিছু মানুষ তাঁকে পেয়েছেন সংগঠক হিসেবে। আর কারও কারও কাছে তিনি ছিলেন সবচেয়ে আপনজন, কাছের মানুষ, বন্ধু, সঙ্গী। আমার প্রাণের মানুষটিকে তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ করতে চাই তাঁরই কথায়, গানে, শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়।

এই স্বল্প সময়ের ক্ষুদ্র জীবনে যা কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, তা অনেকটাই এই মানুষটাকে ঘিরে। ভেবে দেখলাম, জীবনের প্রথম ভাগেই আমি তাঁকে পেয়েছি একাধারে একজন সংগীতগুরু, শিল্পী, সংগঠক এবং পরিবারের মানুষ হিসেবে। এই পাওয়া অমূল্য এবং সারা জীবনের সঞ্চয় বলে মনে করি। পারিবারিকভাবে আমার বড় মামি হিসেবে তাঁকে পেয়েছি, তবে প্রায়ই পরিচয় দিতেন ‘আমার ছোট মেয়ে’ বলে। আমার সংগীত আমার সত্তা এবং আমার সংগীতের প্রায় পুরোটাই এই মানুষের কৃতিত্ব। আমার সৌভাগ্য ছিল, যে বাড়িতে হেসেখেলে বেড়াতাম, সেই বাড়িতে এমন এক শিল্পীর গান হতো। তাঁর গান একেবারে শৈশব থেকে শুনে শুনে শেখা, তাঁকে ভালোবাসা এবং তাঁর গানের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি আমার ভালোবাসার উৎপত্তি। ‘চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি তুমি হে প্রভু’—তাঁর ক্যাসেট যখন বাজত, অজান্তেই তাঁর গান নিজের ভেতর নিয়েছি। তিনি যখন সামনে বসে গাইতেন, অবাক হয়ে শুনতাম। এত স্বচ্ছ, এত সুন্দর গান!

মিতা হক ছাত্রছাত্রীদের নিয়েও বেশ মনোযোগী ছিলেন। প্রতি সপ্তাহে বসতেন, গান শেখাতেন, গাইতেন মনের আনন্দে এবং ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাড়িতে আড্ডা দিতেন! আমি গান শুনতাম, মনের অজান্তে নিত্যনতুন সুর মাথায় বুনতে লাগলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গাইব—এ রকম কিছু ভেবে গানের শুরুটা হয়নি আমার। আমার মামির কোলে বসে বসেই এই ভালোবাসার শুরু। প্রচুর গান জানা আছে আমার, তবে ঠিক মনে করে বলতে পারি না কবে শিখেছি বা আদৌ শিখেছি, নাকি শুনে শুনে তোলা। অসংখ্য রাত কাটিয়েছি বড় মামাদের বাসায়। সময়ে-অসময়ে, রাতবিরাতে হঠাৎ ঘুম থেকে তুলে আমাকে ও দিদিভাইকে গান শিখিয়ে দিতেন! কী অদ্ভুত কাণ্ড! ‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি’, ‘দিবস রজনী’, ‘আমায় দাও গো বলে’, ‘কত অজানারে’, ‘আমার নয়ন তব’, ‘জানি তোমার অজানা’—অজস্র গান পেয়েছি তাঁর হাত ধরে।

একদিন বনানীর বাসায় বেশ সকালে আমার ঘুম ভাঙল, দেখলাম মিতা হকের কিছু ছাত্রী বসে ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গাইছেন। আমাকে বসিয়ে বলল, ‘তুই শোনা তো একটু!’ আমার বয়স হয়তো ১৩ থেকে ১৪ হবে তখন। গানটা গাইলাম। শেষ করার পর বলল, ‘তুই তো দমটাও নিস ঠিক যেখানে আমি নিই! “জানি নাই তো তুমি এলে”—এইটুকু একদম আমার মত হয়েছে!’ কী প্রাণখোলা হাসি! এখনো চোখে ভাসে। পরবর্তী সময়ে ছায়ানটের ক্লাসেও তাঁকে পেলাম শিক্ষক হিসেবে। ক্লাসে প্রতিটি গানের ভাব, অর্থ এবং কোন শব্দ কীভাবে, কতটুকু জোর দিয়ে বা ধীরে বলতে হবে, সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যা আমার মতো অনেকেরই সৌভাগ্য হয়েছে শেখার। প্রতিটি অনুষ্ঠানে গান করার আগে আমি তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করে নিতাম, কী গাইব। একবার সম্মেলনে গাওয়ার জন্য একটা গান প্রস্তাব করতেই বলল, ‘সবাই যেটা গাইতে পারে, তুই কেন সেটা গাইবি? তুই আলাদা। এমন গান গাইবি, যা তোকে আলাদা করবে, “জগতে আনন্দযজ্ঞে” করবি।’ বিচিত্র হলেও সত্য, এই মানুষটির ক্ষমতা ছিল আশপাশে একধরনের ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করার, সবাইকে কাছে টেনে নেওয়ার, সাহস দেওয়ার।

মিতা হককে যাঁরাই কাছে বা দূর থেকে দেখেছেন, প্রত্যেকের মনে এ প্রশ্ন এসেছে—একটি মানুষ কী করে সবার আপনজন হতে পারে? সংগঠক হিসেবে যেটুকু আমি নিজে দেখেছি, তিনি এমন একজন ছিলেন, যিনি দেশ ও জাতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। দেশকে অতলভাবে ভালোবাসতেন এবং এক অসাম্প্রদায়িক দেশের স্বপ্ন দেখতেন। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সাংগঠনিক কাজে তাঁর বিচরণ ছিল। হয়তো কেউ ভাবতেই পারত না যে এই মাপের শিল্পী প্রশিক্ষণে যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন সহজে কীভাবে মিশতে পারেন! সবার সঙ্গে এভাবে মিলেমিশে থাকা, মানুষকে আগলে রাখা তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।
পরিবারের একজন সদস্য বা সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য যদি বলি, তাহলে মিতা হকের কথাই বলতে হবে। সবাইকে বেঁধে রাখতেন যাঁরা, তাঁরা ছিলেন খালেদ খান ও মিতা হক, আমার বড় মামা ও মামি। একডাকে সবাই তাঁদের কাছে চলে আসত। বয়সের এত পার্থক্য এবং বড় মামি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে ছিল আমাদের বন্ধুত্ব।

দুই বছর যাবৎ অন্যদের বলতে শুনছি, মিতা হক বড় অসময়ে ঝরে পড়েছেন, এই দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের এ রকম গুণী ব্যক্তির আরও কিছুদিন প্রয়োজন ছিল। নিজেও গত দুই বছর চোখে অন্ধকার দেখেছি। যে মানুষটির আমার জীবনের সব ক্ষেত্রে এত বেশি প্রভাব, যাঁকে দেখে আমার গানের ও সাংগঠনিক জীবনের যাত্রা, তাঁকে এড়িয়ে চলা, ভুলে চলা কি সহজ? তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে কবিগুরুর এই কটি বাক্যই মনে ভেসে আসে এবং গভীর সত্য বলে মনে হয়—
যা হবার তা হবে।
যে আমারে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে?
পথ হতে যে ভুলিয়ে আনে পথ যে কোথায় সেই তা জানে,
ঘর যে ছাড়ায় হাত সে বাড়ায়—সেই তো ঘরে লবে॥