বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি অঞ্চল চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকায় (CHT) চলমান জাতিগত উত্তেজনার মধ্যে পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সরকার তিনটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে ভ্রমণের উপর জরুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলা প্রশাসন আগামী ৮ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে।
প্রশাসনের নির্দেশনা
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলার জেলা প্রশাসকগণ একযোগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানান, “অপরিহার্য কারণবশত” এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে তারা বিশেষ কোনো কারণ উল্লেখ করেননি। রাঙ্গামাটি জেলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন খান বলেন, “এই নিষেধাজ্ঞা তিনটি জেলায় পর্যটকদের জন্য প্রযোজ্য, এবং আমরা সকল পর্যটকদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, তারা যেন এই সময়সীমার মধ্যে এই এলাকায় না আসেন।”
পাঁচজন নিহত, অনেকে আহত
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকায় স্থানীয় জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এই সংঘর্ষের ফলে এলাকায় অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা এবং শান্তি বজায় রাখতে পর্যটকদের এই অঞ্চলে আসা থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছেন।
চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকায় পরিস্থিতির বর্ণনা
চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলটি প্রায় ১৩টিরও বেশি জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর আবাসস্থল, যাদের বেশিরভাগই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এটি বহু বছর ধরে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় একটি গন্তব্যস্থল হিসেবে পরিচিত, যেখানে পাহাড়, ঝর্ণা এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সমন্বয় রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের সাথে স্থানীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
‘কাঠিন চীবর দান’ উৎসব স্থগিত
উল্লেখ্য, এই অঞ্চলে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোও সংঘর্ষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি স্থানীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘কাঠিন চীবর দান’ বাতিল করেছেন। এই উৎসবটি মূলত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, যেখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হলুদ বস্ত্র প্রদান করা হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তার অভাবে এই উৎসবটি বাতিল করা হয়েছে।
জাতিগত উত্তেজনার কারণ
চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকায় বহু বছর ধরে জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে জমি ও অন্যান্য সম্পদ নিয়ে বিবাদ চলছিল। বাঙালি বসতি স্থাপনকারীরা সাধারণত দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে এসে এখানে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন, যা স্থানীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সাথে নানা সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিবাদ আরো তীব্র হয়েছে এবং এর ফলে এলাকায় জাতিগত উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়াও, পড়ুন : গ্লোবাল লং হ্যান্ডেল স্টিরাপ হোস মার্কেট
পর্যটন শিল্পে প্রভাব
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্পও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৌদ্ধ মঠ, এবং পাহাড়ি সংস্কৃতির কারণে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যস্থল। বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলায় প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেন। নিষেধাজ্ঞার ফলে এই পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যাবে এবং এর ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং পর্যটন খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মজীবীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর পদক্ষেপ
সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে এবং তারা এলাকায় টহল দিচ্ছে। প্রশাসন আশ্বস্ত করেছে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে এবং পুনরায় পর্যটকদের এই এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।
এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনী সতর্ক রয়েছে, যাতে নতুন করে কোনো সংঘর্ষ বা সহিংসতা না ঘটে। স্থানীয়রা এবং পর্যটকরা উভয়ই প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন, তবে তারা আশা করছেন যে পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে এবং পুনরায় তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে পারবেন।
উপসংহার:
বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকায় চলমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ৮ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সংঘর্ষ এবং নিরাপত্তা সমস্যার কারণে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রশাসন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, এবং পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তার জন্য নির্দেশনাগুলি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।