দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত অটোমোবাইল নির্মাতা হুন্দাই মোটর ভারতের বাজারে তাদের বহুল প্রতীক্ষিত শেয়ার অফারের এক ধাপ কাছে পৌঁছে গেছে। হুন্দাই মোটর ইন্ডিয়া লিমিটেড, যা হুন্দাই মোটরের ভারতীয় শাখা, সম্প্রতি ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে তাদের প্রাথমিক শেয়ার প্রকাশের (আইপিও) অনুমোদন পেয়েছে।
ভারতের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড (এসইবিআই) হুন্দাই মোটরের আইপিওর জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন সম্প্রতি অনুমোদন করেছে বলে বুধবার ভারতীয় মিডিয়া এবং শিল্প সূত্র জানিয়েছে।
২০২৪ সালের জুন মাসে, হুন্দাই মোটর ইন্ডিয়া তাদের খসড়া রেড হেরিং প্রস্পেকটাস (ডিআরএইচপি) জমা দিয়েছিল, যেখানে তারা প্রায় ১৮ বিলিয়ন থেকে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে বাজারমূল্য নির্ধারণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।
আইপিওর বিশদ বিবরণ:
ডিআরএইচপিতে হুন্দাই মোটর ইন্ডিয়া উল্লেখ করেছে, “এই প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য হল ১৪ কোটি ২১ লাখ ৯৪ হাজার ৭০০ শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব এবং ভারতে শেয়ার তালিকাভুক্তির সুবিধা অর্জন করা। তালিকাভুক্তির ফলে কোম্পানির দৃশ্যমানতা এবং ব্র্যান্ড ইমেজ উন্নত হবে, এবং শেয়ার বাজারে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে।”
বাজার বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন যে, অক্টোবর মাসে আইপিওটি সম্পন্ন হতে পারে। এতে করে হুন্দাই মোটরের আইপিও ভারতীয় শেয়ার বাজারের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ হতে পারে, প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমানের।
২০২২ সালের মে মাসে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত জীবনবীমা কর্পোরেশন (এলআইসি) তাদের আইপিও থেকে প্রায় ২.৭ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছিল, যা এখন পর্যন্ত দেশের সর্ববৃহৎ আইপিও ছিল। হুন্দাই মোটরের আইপিও সেই রেকর্ড ভাঙতে প্রস্তুত।
হুন্দাই মোটর ভারতে শেষ দুই দশকের মধ্যে প্রথম অটোমোবাইল নির্মাতা হতে চলেছে যারা শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হবে। এর আগে ২০০৩ সালে জাপানের মারুতি সুজুকি ইন্ডিয়া লিমিটেড শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছিল, যা এখনও দেশের সর্ববৃহৎ অটোমোবাইল ব্র্যান্ড হিসেবে টিকে আছে, প্রায় ৪২ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে।
ভারতীয় বাজারে হুন্দাই মোটরের উপস্থিতি:
২০২৪ সালের প্রথমার্ধে হুন্দাই মোটর ভারতীয় বাজারে দ্বিতীয় বৃহত্তম অটোমোবাইল ব্র্যান্ড ছিল, যেখানে তারা ৩ লাখ ৯ হাজার ৭৭২ ইউনিট বিক্রি করেছিল এবং ১৪.৩ শতাংশ বাজার দখল করেছিল। একই সময়ে, মারুতি সুজুকি প্রায় ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৯০৫ ইউনিট বিক্রি করে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিল।
হুন্দাই মোটরের ডিআরএইচপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা ২০০৯ সাল থেকে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অটোমোবাইল নির্মাতা এবং ২০০৫ থেকে ২০২৪ সালের প্রথম ১১ মাস পর্যন্ত ভারতের সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী গাড়ি রপ্তানিকারক হিসেবে রয়ে গেছে।
১৯৯৮ সালে হুন্দাই মোটর তাদের ভারতীয় প্ল্যান্টে উৎপাদন শুরু করে এবং তারপর থেকে তারা প্রায় ১.২ কোটি যাত্রীবাহী গাড়ি ভারতীয় বাজারে এবং রপ্তানি করেছে।
বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ:
বিশেষজ্ঞদের মতে, হুন্দাই মোটরের আইপিও কোম্পানির ভারতীয় বাজারে উপস্থিতি আরও জোরদার করবে এবং ভারতের জনগণের মধ্যে তাদের ব্র্যান্ড ইমেজ আরও দৃঢ় করবে। দায়লিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অটোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক কিম পিল-সু বলেন, “ভারতে আইপিওর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে কারণ ভারত এখন বিশ্বের নতুন উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে চীনের স্থানে উঠছে। ভারতের অটোমোবাইল বাজার অত্যন্ত দ্রুতবর্ধনশীল এবং সম্ভাবনাময়। হুন্দাই মোটর তাদের আইপিওর মাধ্যমে ভারতের জনসাধারণের কাছে তাদের গাড়ি ‘ভারতে তৈরি’ হিসাবে তুলে ধরতে চায় এবং তা ভারতীয় জনগণের জন্য গর্বের বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।”
তিনি আরও বলেন, “হুন্দাই ইতিমধ্যে ভারতের বাজারে একটি ভালো সুনাম অর্জন করেছে এবং আইপিও তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালুকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।”
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা:
বর্তমানে, হুন্দাই মোটর ভারতের বাজারে ১৪টি মডেল সরবরাহ করছে, যার মধ্যে সেডান, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল (এসইউভি), এবং হ্যাচব্যাক রয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তারা আরও ছয়টি নতুন মডেল লঞ্চ করার পরিকল্পনা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে আইওনিক ৬ এবং ক্রেটা ইভি।
ভারতে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির চলমান প্রকল্পগুলির অধীনে, হুন্দাই মোটর গ্রুপের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে ১৫ লাখ যানবাহনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
হুন্দাই মোটর তাদের ভারতীয় শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে না, পাশাপাশি ভারতীয় অটোমোবাইল বাজারে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করবে।
উপসংহার:
ভারতে হুন্দাই মোটরের আইপিও তাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এই তালিকাভুক্তির মাধ্যমে তারা ভারতীয় বাজারে আরও গভীরভাবে প্রবেশ করবে এবং ‘ভারতে তৈরি’ হিসেবে তাদের গাড়িগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করবে। তবে সময়ই বলবে এই আইপিও কতটা সফল হবে এবং এটি কোম্পানির ভবিষ্যত ব্যবসায়িক কৌশলে কী প্রভাব ফেলবে।